খুব বেশি দেরি নেই,আর কয়েকটা ভোরের পরেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের শ্লোকপাঠ উন্মোচিত করবে “পূজো-পূজো” আবরণকে,পূজো এসেছে!শপিংমলে ঢোকার মুখটায়,মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলা হাওয়াটা,শরীরের সব ময়লা সরিয়ে নতুন নতুন রূপে শোভিত সভ্য হওয়ার আকুলতা জানিয়েছে,নতুন জামার গন্ধে আলমারির তাকগুলো আটটা দশটা করে শূন্যতা হারাচ্ছে,
সেই সংগে শ্রেণীবৈষম্যের তফাৎটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে, “সভ্য” ও “অসভ্যে”র একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ছে।
কি মনে পড়ে গেল না?নন্দন,পার্কস্ট্রিট,গড়িয়াহাটের মোড়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলের মাথা গুলোর কথা?দুটাকা দেওয়ার ইচ্ছে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ডেনড্রাইট আসক্ত হওয়ার তীব্র ক্ষোভটা মনে পড়ে গিয়েছিল না?? তাই আবার দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাবু সাজতে হলো।একটু অন্য গল্প শুনবেন??
শহর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়ার ‘পুঞ্চা’ গ্রাম,বাস থেকে নেমে প্রথমে মনে হবে,না!ঠিকই তো আছে সব! তারপর মেইন রোড থেকে আস্তে আস্তে রাঙামাটির পথ বেয়ে,বিস্তৃত শূন্যতার দিকে হাঁটতে হাঁটতে পা-দুটো কেমন ভারী হয়ে যাবে। শবর, আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন কতগুলো পাড়া,সভ্যতার অনেকটা পিছনের গল্প তাদের প্রত্যেকের উনুনে,জ্বালানির প্রতুলতা থাকলেও সিদ্ধ করবে কাকে??যেখানে একবেলা দুমুঠো ভাত জুটলেই কয়েকটা মেঠো ইঁদূর বেঁচে যায়,সেখানে শিক্ষা,বস্ত্রর মত মৌলিক চাহিদাগুলো বিলাসিতাই বটে,তাই আমার আপনার মত আতুপুতু করে বড় হয়ে উঠতে পারেনা ওদের শৈশবগুলো।কাঁধেতে টিফিনবাক্স আর পিঠে ভারীব্যাগ ঝুলিয়ে,স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করার ঝুটঝামেলা থেকে বেঁচে যায় ওরা।বেঁচে যায় উঠতে বসতে ‘Twinkle twinkle little star’ আওড়ানো থেকে।
হয়তো নবদিশার বানী এসেছিল অরূপবাবুর কাছে,নিজের উদ্যোগে একটা স্কুল খুলে ফেললেন।শবর, আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে,বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোগাড় করেন ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী বাচ্ছাদের,উদ্যেশ্য থাকা খাওয়ার অছিলায় যদি একটু শিক্ষার আলো দেখানো যায়।তাদের মধ্যে আছে নিশার মতো অনাথ,আছে কাজলের মতো হতভাগী, যাকে কিনা ক্ষিদের জালায় নিজের মা পুড়িয়ে মারতে গিয়েছিল,কিন্তু খুব অদ্ভুত ভাবেই বেচারির জামাতে বড় করে “I Love Mummy” লেখা,
এমন অসংখ্য শিশুদের উদ্ধার করেন অরূপ বাবু।
পেশায় কলকাতা পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল অরূপবাবু নিজের মাইনের বেশিরভাগ টাই এই স্কুলের জন্য ইনভেস্ট করেন,
না!কোন প্রফিট ছাড়াই। স্কুলের বাচ্ছাদের সংখ্যা এখন একশো ছুঁয়েছে, কিন্তু কি অদ্ভুত একশোটা বাচ্ছার কোলাহল আপনাকে বিরক্ত করবে না,নিষ্পাপ মুখগুলোকে দেখলেই কোলে তুলে আদর করতে মন চাইবে,দিব্যি মিশেও যাবে ওরা,খুব তাড়াতাড়ি আপনার সাথে।সারারাত জাগা জার্নিটা কোথায় যেন উবে গিয়েছিল ওই হাসিগুলো দেখে। অরূপ বাবুর কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে রোজকার খাবারের জোগান দিতে হয়তো আমরা ব্যর্থ,কিন্তু চেয়েছিলাম নতুন জামার গন্ধ দিয়ে যদি ওদের শরৎকালীন আকাশ-টাকে একটু নীল করা যায়।সোয়াবিন-ভাতের খিদে পাওয়া,লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লজ্জা ও আনন্দের মুখগুলো একে একে পোশাক বিলাসিতার রঙ চিনে নিচ্ছিলো।
স্কুলের খোঁজটা আমরা পাই তিয়াষ দির থেকে,যাকে দেখে আমরা সাহস পাই আরও আরও কাজ করার, যার জন্য নিশা, কাজল,বাসুদেব, রমেশ,সাগরদের গল্পের সাথে আমাদের পরিচয়, আলাপ। ভালোবাসা নিও দিদি।ভালোবাসা নিও বাদলদা, পারমিতা,সৌভিক দা। বাদলদা, তোমার বন্ধু-সুলভ ব্যক্তিত্ব আপনা থেকেই তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করায়,
পারমিতা,বাচ্চাগুলোকে এত তাড়াতাড়ি নিজের বাচ্চা করে নাও কিভাবে বলতো? আর সৌভিক দা ওইদিন পুরনো জামা না পেয়ে কাঁদতে থাকা বাচ্চাটার মধ্যে তোমাদের কাঞ্চনকে খুঁজে পাওয়াটা কেমন জানি কাঞ্চনের প্রতি ভালোবাসাটা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা,আর অরূপদা তোমাকে নিয়ে কি বলি বলোতো!তুমিই তো এই গল্পের রচয়িতা।
ধন্যবাদ ও ভালবাসা সকল বন্ধুদের যারা নিজেদের খরচার কিছুটা বাঁচিয়ে,এগিয়ে এসে হাতে হাত ধরেছ,ধন্যবাদ তাদের সকলকে যাদের মাইনের কিছুটা একটা বাচ্চাকে হলেও নতুন লাগিয়েছে……
কি?গল্পগুলো পড়ে, মহালয়ার ভোরটা আসতে একটু দেরি মনে হচ্ছে না?ঢাকের আওয়াজ টা একটু ক্ষীণ লাগছে না?
পূজো নামুক,তর্পন এর সাথে ধুয়ে মুছে যাক সব মলিনতা,শরীরে নতুন জামার গন্ধে ম ম করুক,শুধু গন্ধটুকু ছড়িয়ে পড়ুক অনেক অনেক দূরে,কোনো বাধা ছাড়াই।
“ঘুলঘুলি”