#ঘুলঘুলি_তার_সাধ্য_মতো_চেষ্টা_করে_চলেছে
#পাথরপ্রতিমার_বনশ্যামনগরে_১০০টি_পরিবারকে_কয়েকদিনের_রেশন
 
বেশ কয়েকদিন আগে একদিন সন্ধ্যেবেলা বাদল দা’র মেসেজ- ‘পাথরপ্রতিমার বনশ্যামনগর বলে এক জায়গায়, নদীর জল ঢুকে খুব ক্ষতি হয়েছে, সেখানে ১০০ টার মতো পরিবারের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে, ভালো করে খোঁজ নিয়ে কাজটা করে আসতে পারবি?’ ব্যাস, তারপরে ওখানকারই বাসিন্দা প্রতিমা দির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম। ওখানকার সব খোঁজ, ডিটেলস, ছবি পেয়ে ভালো করে দেখে কাজে নেমে পড়া। ঠিক করা হলো জিনিসপত্র সব ওখান থেকেই নেওয়া হবে, তাতে ট্রান্সপোর্ট এর খরচটা বাঁচবে সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও লাভের একটা অংশ তুলে দেওয়া যাবে।
 
প্রোগ্রামের দিন সকালে একটা খেয়া, আধা ঘন্টার ভুটভুটি আর বাইকে কয়েক ঘন্টার রাস্তা এই সব কিছু মিলিয়ে আমি আর ভাই পৌঁছলাম গ্রামটাতে। দুজনে প্রোগ্রাম নামানোর একটা হাল্কা যে চাপ খাচ্ছিলাম সকাল থেকেই, সেটা ওখানে গিয়ে পুরোপুরি কেটে গেলো। যাওয়ার পর থেকেই আত্মীয়তা শুরু, এদিকে প্রতিমাদি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কোথায় বসতে দেবে আমাদের! বুঝতেই পারছিলাম না কাজ করতে গেছি নাকি অনুষ্ঠান বাড়িতে। গ্রামের বউরা, ছেলেরা এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও চলে এসেছে প্যাকিংয়ে সাহায্য করতে। বাচ্চাগুলোর কেউ কেউ হলুদ লঙ্কার প্যাকেটগুলো কেটে দিচ্ছে, কেউ নানা দফার জিনিসগুলো গুনে ঢোকাতে গিয়ে ভুল করছে, জিভ কেটে আবারও গুনছে, কেউ প্যাকিংয়ের পরে প্যাকেট গুলো ছুটে গিয়ে এক জায়গায় করছে, সে এক হুলুস্থুল পরিবেশ একদম!……দেখে বোঝা যাচ্ছিলো না ঠিক কটা দিন আগেই নদীর জল ঢুকে ওদের কত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, বোঝাই যাচ্ছিলো না, ওদের পুকুরগুলোতে আর মাছ নেই বলে, ওদের চাষজমিতে চাষ হবে না বলে, বরোজগুলো এখনও তোলা যায়নি বলে। বাড়িগুলোর মাথায় টালি, ত্রিপল না চাপানোর কষ্টগুলো বোঝা যাচ্ছিল না ঠিক। ওরা এমনই! এতদিনেও ইলেক্ট্রিসিটি না আসা সত্ত্বেও ওদের পথ অবরোধ নেই কোথাও, লম্পর আলোয় কাজ মিটিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুয়ে পড়েছে রোজ। নোনা জলে হলুদ হয়ে যাওয়া পুরো জায়গাটায় আবার প্রাণ ফিরে আনার চেষ্টা করছে সকালে উঠে, আবারও ঘর বাঁধছে। ওরা ভালো থাকে এত অল্পকিছুতেই। ওরা ভালো থাকে ছাগল গুলোর পেটভরে ঘাস খাওয়াতে, গরুটা দুপুরে জল পেলোতো!? এই ভাবনাতেই।
তাই সরকারি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজেরাই দল বেঁধে নদীর বাঁধ দিয়েছে, নিজেরাই উপড়ে যাওয়া গাছ গুলো সরিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি আনার কাজটা এগিয়ে রাখছে। চাওয়া পাওয়াগুলো খুব অল্প ওদের কাছে, তাই কোনো অভিযোগও নেই।
এখনও পর্যন্ত কোনো দল না পৌঁছনোর কারণে, ওদের এই অল্প কিছু পাওয়ার উছ্বাসটা বোঝা যাচ্ছিলো পুরো গ্রাম জুড়ে।
 
আমাদের এই কাজটা করতে সাহস জুগিয়েছিল Desi Nomadz বলে ট্রাভেল স্টার্টআপ। আমাদেরকে সুদীপ্তদাই এই গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়েছিল, মোট ৫০ টা পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিল ওরা। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে গড়ে ওঠা একটা গ্রুপের এমন ভাবে এগিয়ে আসার জন্য অনেক ভালোবাসা প্রাপ্য ওদের আর ভালোবাসা-শ্রদ্ধা বাদলদা কেও, ঘুলঘুলিকে দাদার মতো করে এমন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সবসময় ঘুলঘুলির পাশে থাকার জন্য।
 
যেহেতু ক্রাউড ফান্ডিং তাই কি কি জিনিসপত্র ছিল সেটা দেখানোরও প্রয়োজন রয়েছে কিছুটা। আমরা মোট ১০০ টা পরিবারের কাছে কিছুদিনের রেশন পৌঁছে দিয়েছিলাম, প্রতি পরিবার পিছু ছিল ১১ রকমের জিনিস….
আলু- ২ কেজি
পেঁয়াজ-৫০০ গ্রাম
ডাল-৫০০গ্রাম
সরষের তেল-৫০০ গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো-২ প্যাকেট
লঙ্কা গুঁড়ো-২ প্যাকেট
লবন-১ কেজি
সোয়াবিন-১ প্যাকেট
টুথপেস্ট, সাবান ও মশার মারার ধুপ।
 
প্রতিবারের মতো এবারও বলছি হয়তো খুব সামান্য কিছু নিয়েই পৌঁছে যেতে পেরেছি ওদের কাছে, কদিন কিছুটা স্বস্তিতে থাকবে হয়তো ওরা। কিন্তু আমরা চেষ্টা করে গেছি আমাদের সবটুকু দিয়ে, অবশ্যই আপনাদের সাহায্য নিয়ে। শুধুমাত্র কিপ্যাডে বিদ্রোহ-সহানুভূতি না দেখিয়ে এই যে সামান্য চেষ্টা নিয়ে এগিয়ে এসেছি আমরা, আপনারা, এটাই কম কিসের বলুন! কিছু না করার থেকে কিছু অন্তত করাটা বেশি ভালো, তাই না?! সেটা হোক না এক কেজি পেঁয়াজের খরচ তুলে দেওয়া, কম কিসের!ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে যারা আমাদেরকে ভরসা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, আশা রাখছি এভাবে ভবিষ্যতেও হাতগুলো বাড়িয়ে দেবেন।
তবে সবশেষে উপরি পাওনাগুলো কিন্তু আমরা যারা কাজগুলো করতে যাই তারাই প্রাণভরে নিয়ে আসি। সবশেষে খালি হয়ে যাওয়া বস্তা, ব্যাগ গুলোতে ওদের এতো এতো ভালোবাসা, আশীর্বাদ ভরে নিয়ে আসি, খালি হাতে ফিরিনা কোনো বারেই…, বেশ কয়েকটা নতুন আত্মীয়, দুপুরের ডিমভাত, আবারও আসার আবদার, একদম অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওদের হাত নেড়ে যাওয়া, এমন আরও অনেক অনেক অনুভূতি…!
 
সন্ধ্যে বেলা প্রতিমাদির ফোন- “ভাই কখন পৌঁছালে তোমরা? ভুটভুটি, খেয়া ঠিকমতো পেয়েছিলে তো, বাইক আস্তে চালিয়ে গিয়েছিলে তো?!”
 
-তাপস