মিনাখাঁ সফর আমাদের ঘুলঘুলি পরিবারের সমস্ত সদস্যদের আর কিছু হোক না হোক প্রকৃতি আর ক্যাপিটালিসম এর ভয়াবহ দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
আর বছর আটেক আগে বাকি নব্বই শতাংশ ঘূর্ণিঝড়ের মতো শুধু ওড়িশা উপকূলে নাচানাচি না করে আর একটু বেশি সাহস করেই মনে হয় ‘আয়লা’ এগিয়ে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের দিকে। সুন্দরবনের কাছাকাছি এই কয়েকটা গ্রাম প্রবল আঁচ পেয়েছিল তার প্রলয়-নাচনের। ফলাফল-সমস্ত চাষযোগ্য জমিতে ধানের বীজ বোনাই দায়, তার ওপর বাড়িঘরগুলো কাকতাড়ুয়ার মতো কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে… কোথাও আবার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। এমনই সঙ্কটে খানিক দূরেই তৈরি হওয়া পর্বতপ্রমাণ কারখানাতে কাজের সুযোগটা যেন অনেকটা লটারি জেতার মতো। কাজের আয় ধানচাষের চেয়ে ঢের বেশি, তাই বাড়তি খাটুনি কম, চিন্তা কম, প্রকৃতির ওপর নির্ভরতাও কম, দ্বায়বদ্ধতাও কিছুটা হয়তো কম আর সবচেয়ে বড় কথা কোন অনিশ্চয়তা নেই বরং একদম ধরাবাঁধা একটা টাকার হিসেব পাওয়া যায় মাস গেলে।।
গোয়ালদহ, দেবীতলা, ধুতুরদহ ও জয়গ্রাম এই চার গ্রাম থেকে শয়ে শয়ে মানুষ যোগ দিলেন পাথর কারখানাতে। তাৎক্ষণিক নিশ্চর হাসির উৎস যে বছর কয়েক পর তাদের রাতের দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে ভাবতেও পারেননি ওই অল্পে খুশি থাকা মানুষগুলো। সঠিক সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া পাথর কারখানাতে ‘সিলিকোসিস’ অবধারিত। এই মারণরোগের চক্করে বছর তিনেকের মধ্যেই প্রাণ হারালেন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৫০ এর ওপরে যুবক। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ জনের ওপর ‘সিলিকোসিস’ এ আক্রান্ত।।
রোগের মূল উপসর্গ, ফুসফুসে যথেষ্ট অক্সিজেনের অভাব। স্বাভাবিক ভাবেই মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় আজীবন অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপরিসীম জোগান। একটি গোটা সিলিন্ডার শেষ হয় রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে। স্থানীয়দের মতে এমন ও নাকি হয়েছে যে মৃত্যুর আগের দিন একজন মাত্র আধ-বেলায় একটি আস্ত সিলিন্ডার টেনেছেন। একটি সিলিন্ডার কিনতে খরচ প্রায় ৮০০০ টাকা… সেটি পুনরায় ভর্তি করতে ৩০০ টাকা। ইনহেলার লাগে মাসে ২ টি, প্রতিটির দাম ৪০০ মতো। সমস্তটা একজায়গায় ঝট করে লিখে ফেললে প্রতি মাসে রোগী পিছু মোট ব্যয় মাঝে মাঝে যে ৩০০০ ছাড়িয়ে যায় সেটা পরিষ্কার।
এবার আসা যাক সারা বছর ধান চাষ করা আর বর্ষাকালে ধান জমিতে জমা জলে মাছ চাষ করা পরিবারগুলোর কথায়। আমাদের এক উৎসাহী বন্ধু জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা আপনাদের সরকার থেকে সাহায্য করা হয়না!?’
‘ওদের ভাবটাই এরকম যে আমাদের কাছে না এলেই যেন ভালো হয়’ স্থানীয় মহিলার ভারাক্রান্ত মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কথাটা।
আরও খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম যে শুরু থেকেই নাকি কারখানার মালিক উদাসীন, সরকারকে বহু আবেদন করা সত্ত্বেও সরকার নিরুত্তাপ। এদের পুরো খরচটাই নিজেদের চালাতে হয়। সাহায্য?সেতো নগন্যমাত্র, ঠিক যেমন আমরা এগিয়ে এসে অতি-তুচ্ছ কিছু করতে পারলাম তেমনি মাঝে মাঝেই বিভিন্ন NGO আসে… সাধ্যমতো সাহায্য করার সাহসটা দেখিয়ে যায় অন্তত। কিন্তু ঐযে, ধারাবাহিকতার অভাব। সরকার থেকেও নাকি মাসে ১ বার করে মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হচ্ছে কয়েক মাস যাবৎ। তবে ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে সেই ক্যাম্পগুলোতে ওষুধের অভাবটা যেন কিছুটা প্রত্যাশিত।।
স্থানীয় কৃষক বঙ্কিম মণ্ডল এর আধা-তৈরি পাকা বাড়িটা প্রথমেই আমাদের অবাক করে, বিশেষত সমস্ত ঝুপড়ি ঘরের মাঝে একতলা বাড়িটাকে প্রাসাদ মনে হতে বাধ্য। বঙ্কিমের দুই ছেলে সরজিৎ আর বিশ্বজিৎ,দুজনেই যে সিলিকোসিস-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তখনও জানা ছিলনা আমাদের। বাড়িটাতে এখন উপার্জনের লোক একটি,বঙ্কিম, তিনিও সিলিকোসিস আক্রান্ত। বড় ছেলের বউ আর এক মেয়ে, যে আবার নাকি সবেমাত্র একটু আধটু পড়তে শিখছে। সাদর আপ্যায়ন আর ব্যাবহারে এটুকু বোঝার উপায় নেই যে এদের ওপর দিয়ে আয়লার চেয়ে বহুগুণে ভয়ানক এক ঝড় গেছে বছর দুয়েক আগেই। যদিও বেরোনোর সময় বিশ্বজিতের মায়ের স্বগতোক্তি স্তব্ধ করে দেয়,
‘এতো বড় বাড়ি করে কি আর হল যখন থাকার লোকই নেই!!
শরিফুল দা যিনি শুরু থেকেই আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, বললেন “আগে আমিও যেতাম, এখন আর যায়না,তবে আক্রান্ত আমিও” স্ত্রী,বাবা মা দুই ছেলেমেয়ের সংসারে উনিই একা উপার্জনকারী,তবে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশি ভারী কাজ করতে পারেননা, শ্বাসকষ্ট হয়। কখনও বেশ সচ্ছল পরিবারের শরিফুল দা এখন বাড়ি বাড়ি ফেরি করেন।
গত পঁচিশে অক্টোবর স্থানীয়রা একটি মিছিলের আয়োজন করেন মালঞ্চ থেকে মিনাখাঁ পর্যন্ত। মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রায় ২০০০ ছাড়িয়ে ২৫০০ ছুঁই ছুঁই। দাবি ছিল যে সিলিকোসিস এ আক্রান্ত পরিবারের জন্য পেনশন ব্যাবস্থা চালু করার এবং গ্রামে একটি ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার। আজকালকার বাকি ৫-১০ টা ঘটনার মতো এখানেও নাক গলাতে চলে আসে উঠতি রাজনৈতিক দলের লোকজন, প্রচার চালানো হয় যে তারাই নাকি মিছিলের আয়োজক।কিন্তু এদের একতায় তাঁরা বিশেষ একটা সুবিধা করতে পারেননি।
এমনই এক শুন্যপুরীতে ‘ঘুলঘুলির’ ২৫০ টা কম্বল মানুষগুলোর জীবনে আদও কতটা উষ্ণতা এনে দিতে সক্ষম হলো জানিনা…….
প্রসঙ্গত,মিনাখাঁর অধ্যায় টা আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত যদি না,শাহ রেজাদা আমাদের কে এই খোঁজ দিতেন। আমাদের এই সামান্য উদ্যোগটুকু সম্ভব হতোনা যদি না পাশে পেতাম প্রদ্যুতদা ও সহিদুল দা কে,আপনারাই তো এদের আশা, ভরসা।আপনাদের জন্য শুধু নিখাদ ভালবাসা রইল। অনেক ধন্যবাদ ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক সংগঠনে’র বাকি সবাইকে, যাদের সাহায্য ছাড়া আমরা এই কাজটা সফল ভাবে করতে পারতাম না।
আর ভালোবাসা সেই সব শ্রমিকদের যাদের প্রতিদিনের ঝরেপড়া ঘাম সভ্যতার চাকাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।ধিক সেই পুঁজিবাদ কে, যে পুঁজিবাদ শ্রমিকের জীবনের মূল্যে দিনে দিনে বলিষ্ঠ হচ্ছে।
কবি তো কবেই বলে গেছেন-
“বলোতো এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা,
কার খুনে রাঙা, ঠুলি খুলে দেখো,প্রতি ইঁটে আছে লিখা”
যদি ইচ্ছে হয় আপনিও পারবেন আমাদের পরবর্তী সফরের অংশ হতে, সত্যি বলুন তো অতটাই কি কঠিন নাকি সেটা ??